নতুন বাংলাদেশ
আর আই রাতুল
ভোরের আলো তখনো ফুঁটে নি।
দুটি ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে হারিকেনের ক্ষীণ আলোয়।তার একটি হচ্ছে নরেশ মাঝির আর অন্যটি হচ্ছে রফিকের।
নরেশ মাঝি বরাবরই তাড়াহুড়ো করছে।সকাল ৭টার ভিতরেই বড় খালটা পার হয়ে বেশ কিছুদূর যেতে হবে।একলাশপুরে অপরেশন আছে।
নরেশ মাঝি বললো,”রফিক্কা,আর কতক্কন এরুকুম বই থাকইবি?হুন,যত দেরি করুম,তত বিপত আইবার ডর আছে।তুই যানছ না,বড্ডা খালে বেইন্না মিলিটারি আইয়ে?তন আমরা কেন্নে যামু?”
রফিক কোন উত্তর দেয় না।মাথা নিঁচু করে বসে থাকে কেবল।সে রহিমা বানুকে বিয়ে করেছে বছর খানেক গড়িয়েছে।তাদের ১ম সন্তান হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবূর আলো দেখবে।রফিক তাকে প্রাণভরে দেখতে চায়,তার কান্নার শব্দ শুনতে চায়,তার ছোট্ট দেহটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতে চায়,তার কান্নার শব্দ শুনতে চায়,প্রাণভরে তার গায়ের ঘ্রাণ নিতে চায়।কারণ রফিক যদি যুদ্ধে শহিদ হয়,তার সন্তান বড় হয়ে সান্ত্বনা পাবে এই যে,তার আপন পিতার কোল,স্পর্শ,আদর থেকে সে বঞ্চিত হয় নি।
রফিক ক্ষণে ক্ষণে টের পায়,সে যা ভাবছে,তা হয়তো সম্ভব না,তবুও ক্ষীণ আশায় সে এখনও বসে আছে।
নরেশ মাঝি রফিকের কাঁধে হাত রাখলো,আর বললো,”ভাই,তোর মনের অবস্তা আই বুঝি।বাঁচি যদি থাস,তুই তোর বাইচ্ছারে ঠিকে দেখবি।মনে বল রাখ,নাইলে যুদ্ধ কইরবি কেন্নে?নে ব্যাঠা,উঠ,বদরুল কেপ্টিন ৭টার আগে হিয়ানে যাই,হোচ অইবার লাই কইছে।”
রফিকে সেই ক্ষীণ আশাটুকুও ভেঙ্গে চুরে তছনছ হয়ে গেলো।তখনও রহিমা বানুর চিৎকার শোনা যাচ্ছে।গ্রামের দক্ষ ধাত্রী,দশ গ্রামজুড়ে যার নাম,সেই মজিয়া ধাত্রী চেষ্টা করছেন।কিন্তু সুবিধা করতে পারছেন না।মজিয়া ধাত্রী খারাপ কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছেন।দেশের অবস্থা খুবই খারাপ।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবারও সুযোগ নেই।
রফিকের মা হুসনেহারা বেগম ঠান্ডা বরফ জলে ওযু সেরে দু রাকাত নামাজ আদায় করে লম্বা মোনাজাতে বসলেন।
রফিক ভেতর থেকে ডেকে পাঠালো মজিয়া ধাত্রীকে।
-“জ্যাঠি,কী খবর?”
মজিয়া ধাত্রী আতংকিত হয়ে বললেন,”খবর বেশি বালা ন।ডাক্তর অইলে বালা অইতো।রতন ডাক্তর ত ইন্ডিয়া ধাইছে।অন আর কিআ?আই চাইয়ের,তুই চিন্তা করিচ্ছা।”
রফিক কপাল ভাঁজ করে একটা সোনার চিকন হার হুসনেহারা বেগমকে ডেকে হাতে দিয়ে বললেন,”মা,আই যাইয়ের।আর লাই দোআ করিয়েন।আর য়ার বাইচ্চা অইলে,হের গলাত চেন ইয়ান হড়াই দিয়েন।”
হুসনেহারা বেগম ছেলের কপালে চুমু খেলেন।তবে অশ্রু বিসর্জন দিলেন না। ছেলে যুদ্ধ যাচ্ছে জয় ছিনিয়ে আনতে।তার নিজ ছেলে!এ যে কত আনন্দের, তা বুঝে কেবল হুসনেহারা বেগম নিজে।
রফিক রাইফেলটাকে লুঙ্গির ভেতর গেঁথে ঢোলা শার্টটা পড়ে, বড় চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে নিলো তার শরীর।
তখনো আঁধার।তবে আলোর গর্ভে ধীরে ধীরে পতিত হচ্ছে অন্ধকার।দুটো ছায়ামূর্তি সেই অন্ধকার ঠিকরে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।তাদের টর্চের আলো যতক্ষণ অবধি দেখা যায়,ততক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো হুসনেহারা বেগম।তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
আঁধার গণিয়ে সবে ভোর হলো।দু একটা পাখির ডাক শোনা গেলো ঠিক তখনই।আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলো।এমনসময় বড় খালটার এক কিনার হতে একটা ছইওয়ালা নৌকা ছেড়ে গেলো,হারিয়ে গেলো অবিরাম জলের আলো-আঁধারীতে।
রফিক ছইয়ের ভেতরে বসে চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে,কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে।তার মনোযোগ আর মনোবলের যে মহাসাগর এতোদিন ছিলো,তা যেন শুকিয়ে গেছে।অথচ তাকে দিয়েই রেকি করানোর সিদ্ধান্ত বদরুল ক্যাপ্টেনের।
দেশ কী স্বাধীন হবে?-আজকাল এই প্রশ্ন রফিককে বড্ড তাঁড়া করে বেড়ায়।অথচ আগে সে মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতো দেশ একদিন স্বাধীন হবেই।মুক্ত হবেই।
রফিক নরেশকে বললো,”নরিশ্শা,আঙ্গো দ্যাশ কী হাছা হাছা একদিন স্বাধীন অইবো?”
নরেশ মাঝি অনেকটা অবাক হয়ে বললো,”রফিক্কা,তুই ইগিন কিআা কছ?তুই ওঙ্গা মুক্তিযুদ্ধা তুই ইগিন কইলে কেন্নে অইবো?হুন,আঙ্গ দ্যাশ স্বাধীন অইবো!আমরা রক্ত দিছি না?ইয়াকুইব্বা,তারিক্কা,মুরি দিদি,আসলাম হুজুর ছাড়া আরো কত্ত মাইনসে রক্ত দিছে না?দরকার অইলে আরো রক্ত দিমু,তবুও দ্যাশরে স্বাধীন করি ছাড়ুম,শেখ সাব কিআ কইছে হুনস ন?”
হঠাৎ রফিকের ভেতর কি যেন হলো,সে আলাদা একটা জোস অনুভব করলো।দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত!
আর তার যে সন্তান পৃথিবীতে আসবে,তার একমাত্র পরিচয় হবে, সে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা রফিকের ছেলে।এতক্ষণ যে ভয়টা রফিক পেয়েছিল,তা নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো।তার মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে এলে,”রক্ত যখন দিয়েছি,রক্ত আরো দেব,তবুও এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো,ইনশাআল্লাহ।জয়বাংলা।”
তখন খালের মধ্যে জোরে ঢেউ বইছে।আকাশে কালো মেঘের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।নরেশ অবাক হয়ে দেখছে রফিককে।রফিকের এমন মুখ নরেশ আগে কখনো দেখেনি।
একলাশপুর এসে গেছে।চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করে কাউকে না দেখে নরেশ মাঝি খালের ওই কিনারায় নৌকা ভিঁড়ালো।
রফিক ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল,এমনসময় দেখল,একলাশপুরের মতি মেম্বর পাঁচ-ছয়জন মিলিটারি নিয়ে এদিকেই আসছে।রফিককে দেখিয়ে বললো,”ও,দেখিয়ে স্যার,ও,সালা মুক্তি হে।”
রফিক হামাগুড়ি দিয়ে নৌকার পেছনে সরপ গেলো এবং সেখান থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকলো।দুজন মিলিটারি তার গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।হঠাৎ খালের জলে লুটিয়ে পড়লো রফিক।খালের কিনারা লাল রঙ ছড়াচ্ছে। নরেশ কিছু বুঝে উঠার আগে সেও লুটি পড়লো জলে।
লালে লাল হয়ে গেলো খালের জল।বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক ঘুমিয়ে পড়েছেন।অনন্তকালের জন্য এই নিদ্রা।তাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করার মতো কেউ থাকলো না।ওদিকে রহিমা বানুও ঘুমিয়ে পড়েছে চিরকালের জন্য।তবে সে বৃদ্ধা হুসনেহারা বেগমের কোলে রেখে গেছে,এক নতুন বাংলাদেশ!
সেই নতুন বাংলাদেশ, একদিন নতুন স্বাধীনতা আনবে নিশ্চিত।নতুন মুক্তির গান বানাবে,আকাশে আরো একবার নতুন রক্তিম সূর্য উঠাবে।।