মুসলিম স্থাপত্য : উৎস ও আদর্শ
মাওলানা কবি মুসা আল হাফিজ
৬২২ খ্রিস্টাব্দ । মদীনায় নির্মিত হলো মসজিদে নবভী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাদাসিধে একটি স্থাপনা। সুমিতি ও সরলতা এর সর্বত্র। আড়ম্বর নেই। কিন্তু পরিকল্পনায় সুষম। মসজিদ তৈরী হয়েছে ইট ও মাটির একটি বর্গাকার বেষ্টনী দ্বারা। মাটির মণ্ড দিয়ে তৈরী করা হয়েছে কাঁচা ইট। তাকে রোদে শুকিয়ে স্থাপন করা হয়েছে দেয়ালে। ভিত্তি গড়া হয়েছে শক্ত পাথর দিয়ে। মূল ভিত্তি সমতল থেকে তিন গজ উঁচু । ভিত্তির উপরে বলিষ্ঠ ও পুরো দেয়াল। দেয়ালের উচ্চতা সাত হাত। কেবলার দেয়াল থেকে পেছনের দেয়াল অবধি দৈর্ঘ ১০০ হাত। চওড়া সমপরিমাণ বা কিছুটা কম। মেঝেতে নুড়িপাথর ও বালু মিশ্রিত। পুরো মসজিদে খোলা আছে তিনটি দরোজা। দরোজার দুই পায়া, বানানো হয়েছে পাথর দিয়ে। মসজিদে আছে দুইসারির স্তম্ভ। উভয়সারিতে ১৮ টি করে খেজুরগাছের পিলার। শুরুতে ছাদ আছে কেবল একটি অংশেই।যেখানে নামাজ পড়েন আল্লাহর রাসূল ( সা.)। ছাদটি দাঁড়িয়ে আছে খেজুর গাছের গুড়ির উপর। খেজুর পাতা ও ডালকে বিশেষভাবে কাদায় মাড়িয়ে তৈরী হয়েছে এই ছাদ।
প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পরে মসজিদে তৈরী হলো মিম্বর। ঝাউকাঠের মসৃণ কাঠামো, যাতে আছে তিনটি ধাপ। মসজিদের পূর্ব দিকে মাটি ও পাথর দিয়ে নির্মিত বাসভবন। যার ছাউনি তৈরী হয়েছে খেজুরগাছের ডাল-পাতা দিয়ে। প্রিয় নবী ( সা.) এর নিবাস এখানে। প্রথমে এতে ছিলো দু’ টি কক্ষ। পরে নয়টি কক্ষে উন্নীত হয়েছে।
এ মসজিদ পুণনির্মাণ হয় প্রিয়নবীর ( সা) হাতে আরেকবার। প্রথম নির্মাণের সাত বছর পরে। যখন সম্পন্ন হয়েছে খায়বার বিজয়। আরো জমি ক্রয় করা হলো, মসজিদ সম্প্রসারিত হলো।
এই হচ্ছে মসজিদে নবভী। যা মুসলিমদের ইবাদতগাহ। কিন্তু এ কী শুধু ইবাদতগৃহ?
এ হচ্ছে নবভী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিদিন এখানে শেখানো হয় আল কুরআন, বুঝানো হয় ইসলাম। জানানো হয় জীবন ও জগতের অর্থ ও তাৎপর্য, লক্ষ্য ও কর্তব্য।
এ হচ্ছে মিলনায়তন। অগণিত বিবাদলিপ্ত গোত্র এখানে এসে মিটিয়েছে যুগ- যুগান্তের বিবাদ।এ হচ্ছে মদীনারাষ্ট্রের পার্লামেন্ট। এখানে বসে রাষ্ট্রীয় পরামর্শসভা। এ হচ্ছে ইনসাফের বিচারালয়। গোটা রাষ্ট্রে বচার ও ন্যায়- ইনসাফ নিশ্চিত করা হয় এখান থেকেই। নিষ্পত্তি করা হয় মামলারাজি। এ হচ্ছে সামরিক হেড কোয়ার্টার। এখান থেকে ন্যায় ও সত্যের জন্য পরিচালিত হয় যুদ্ধ।এ হচ্ছে অসহায়দের আশ্রয় ও সেবাকেন্দ্র। ঘরহীন,আশ্রয়হারা, নিঃস্ব – ফকীররা এখানে অবস্থান করেন। এ হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও হৃদয়বৃত্তির চর্চাকেন্দ্র। সাধক ও খোদামস্ত সাহাবিরা এখানে চালিয়ে যান নিবিড় সাধনা!
এই যে বিপুল কার্যক্রম, এর জন্য পরবর্তিতে প্রয়োজন পড়ে আলাদা স্থাপনার। বিভিন্ন শহরে তৈরী হয় বিচিত্র অবকাঠামো। কোথাও সেগুলো ছিল মসজিদলগ্ন।কোথাও থেকেছে পৃথক।অধিকাংশ মসজিদই একটি বৃহৎ কমপ্লেক্স এর কাজ করতো। মুসলিম সমাজ,জীবন ও কর্মধারার কেন্দ্রে যেমন ছিলো মসজিদ, তেমনি মুসলিম স্থাপত্যের কেন্দ্রে ছিলো মসজিদের অবস্থান। মসজিদে নবভীর স্থাপত্য ছিলো পরবর্তী মসজিদসমূহের আদর্শ। এই মসজিদ থেকেই পরবর্তী মসজিদশৈলীর জুল্লাহ,সাহন,মিম্বর,মিনার, কিবলানির্দেশক পাথর, ওযুখানা ইত্যাদির নমুনা বিকশিত হয়, উৎকর্ষ লাভ করে। মসজিদ নির্মাণের কৌশল থেকে গ্রহণ করা হয় মুসলিম স্থাপত্যের বিবিধ শৈলী। ইমারত,দুর্গ,বাসভবন কিংবা অন্যান্য নাগরিক স্থাপনায়ও এই নির্মাণপ্রকরণের প্রতিফলন ঘটে।
মুসলিম সাম্রাজ্য আরবের সীমানার বাইরে যখন গেলো, নানাভাবে সামনে আসলো নিজেদের স্থাপনা তৈরীর প্রয়োজনীয়তা। আবার সামনে হাজির হলো বিচিত্রধারার স্থাপত্য। কখনো সেখানকার পূর্বতন স্থাপত্য শিল্পের ট্রাডিশনকে সংস্কারের প্রয়োজন পড়লো। মুসলিমরা আপন অাদর্শ ও প্রয়োজনের নির্দেশে যা কিছু গ্রহণের, গ্রহণ করলেন। সেই সব ঐতিহাসিকের সাথে আমি একমত নই,যারা বলেন, আরবের সীমানার বাইরে গিয়েই মুসলিমরা ধারণা লাভ করলেন বিচিত্র বালাখানা সম্পর্কে। এবং পার্সিয়ান ও রোমানদের স্থাপত্য দেখেই তারা একে কবুল করে নিলেন!
আমি বরং দেখাবো, মুসলিম স্থাপত্য মূলত ইসলামী উৎস থেকে উৎসারিত। নিজস্ব অাদর্শ ও ভাবধারা থেকেই সে বিকশিত হয়েছে। বিজিত জনপদগুলোর স্থাপত্য ঐতিহ্যকে সংস্কার করেছে এবং ইসলামী জীবনবোধের আদলে তাকে সজ্জিত করেছে। কিন্তু স্থাপত্যের ধারণাসূত্র মুসলিমরা পেয়ে যান ধর্মীয় উৎস থেকেই।
মুশরিক সংস্কৃতির প্রভাব,অশ্লীলতার ছাপ এবং দম্ভ ও অহংকারের আলামতসমূহ ইসলামী স্থাপিত্যকলায় পরিত্যাজ্য। এসব অনুষঙ্গমুক্ত সুউচ্চ অট্রালিকা,সুসজ্জিত বালাখানা, অলঙ্কৃত ভবন,সুরক্ষিত দুর্গ ইত্যাদির সাথে ইসলামের সহাবস্থান স্বাভাবিক। কুরআন মজিদের একজন পাঠক আল্লাহর ভাষ্যে স্থাপত্য নির্মাণের অনুমোদন প্রত্যক্ষ করেন। শৈল্পিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে আবাসনকে পরিচ্ছন্ন, রুচিকর ও অনুপম করার প্রেরণা লাভ করেন। কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করতে গিয়ে তিনি নানাভাবে সাক্ষাৎ পান ‘ হুসুন’ বা সুদৃঢ় কেল্লার, ‘ সায়াসী’ বা সুরক্ষিত দুর্গের,’ কুসুর’ বা সুরম্য অট্টালিকার,’ গুরুফ’ বা কক্ষরাজির, ‘ জুদুর’ বা টেকসই দেয়ালের, ‘ কুরাম্মুহাসসানাহ’ বা সুরক্ষিত জনপদের।
আল কুরআন জানান দেয় ‘ স্বচ্ছ কাঁচ নির্মিত প্রাসাদ’ এর। যা তৈরী করেছিলেন সোলাইমান আ.। সেই কাঁচের প্রাসাদের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো স্বচ্ছ,শীতল জলধারা! (চলমান)