….হঠাৎ এ রাস্তা দিয়ে আসলে যে, কারো বাসা নাকি এই রাস্তা দিয়ে?
…. নাহ চাচা, এই তো একটু বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলাম। এখন আসার পথে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। অটোরিকশা বা টেক্সি কিছুই পাচ্ছি না তাই ভাবলাম এখানে বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষা করি।
…. বৃদ্ধাশ্রমে কেন?
….আসলে চাচা আপনি জানেনই তো, মা মারা যাবার পর বাবা আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। এখন এ বয়সে কে বাবার খেয়াল রাখবে বলো? তাছাড়া এখন বাবার খেয়াল রাখার মতো মানুষ হইছে, মাসের মাস টাকা দিয়ে যাই বা বিকাশে দিয়ে দেই এতেই বাবার হয়ে যায়।
….তোমার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়েছ সুহেল?
….. জি চাচা!
….ওহ! খুব ভালোই করেছ বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এটাই তোমার বাবার প্রাপ্য ছিল!
….আসলে চাচা আপনি কি বললেন ঠিক বুঝলাম না!
…..মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে তো তাই হয়তো আমার কথার সব শব্দ শোনা যায় নি!
….শুনেছি তবে বাবার প্রাপ্য কেন বললেন?
….(কাঁধে হাত দিয়ে বললেন) আসলে রে বাবা সুহেল তোর বাবা যদি আজ বিয়ে করে আরেকটা সন্তান হতো,পরিবার টাকে আরও বড় করতেন তাহলে কি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হতো তোর বাবাকে বল!
…. আসলে চাচা, বাবা তো ওইখানে ভালো আছে। খুব হাসি-খুশিই তো আছেন। বাড়িতে একা একা বোরিং হবেন তাই বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসা।
….হুম রে বাবা, তোদের মতো এত পড়াশোনা করিনি তাই হয়তো এসব বুঝিনা! তবে বল তোর কী খবর?
…এই তো চাচা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
….পাঁচ বছর আগে শুনেছিলাম তুই নাকি সরকারি চাকরি পেয়েছিস?
….হুম চাচা সরকারি চাকরি পেয়ে তো আমার সবকিছু হয়েছে..
…বিয়ে করেছিস, ছেলে-মেয়ে ক’জন?
….একটা ৪ বছরের ছেলে আছে,আর আরেকজন হবে ৭ মাস রানিং।
….ওহ সুহেল ভালো কথা মনে হইছে। বাবা শোন, তোর মা তো তোর আরেকটা ভাই/বোনকে জন্ম দেওয়ার সময় মারা গেছেন! তুই ও তোর বাবার মত ভুল করিস না যদি এ রকমটা কখনো হয় আরকি..
আল্লাহ যেন এমন না করেন তবে নসিবে থাকলে এ ভুলটা করিস না বাবা!
….কোন ভুল চাচা?
….এই যে তোর মা মারা যাবার পর তোর বাবা বিয়ে করেননি তোর মুখের দিকে তাকিয়ে এই ভুলটা,তুই করিস না তোর ছেলের দিকে তাকিয়ে! তোর বাবা নিজের সবকিছু বিক্রি করে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন। তবে আমরা তোর বাবাকে অনেক বলেছি বিয়ে করার জন্য, কিন্তু না তিনি করবেন না! কারণ সৎ মা যদি তোরে নিজের মায়ের মতো আপন করে না নেয়! তাই এগুলো ভেবে আর বিয়ে করেননি এটা হচ্ছে জীবনের চরম ভুল! আরেকটা ভুল করেছেন সেটা হলো তোর সরকারি চাকরি জন্য যখন ঘুষ দিতে হয়েছে তখন গ্রামের জমি-জমা নিজের বসতভিটা বিক্রি করে দিয়েও ভুল করেছেন! আমরা অনেক বুঝিয়েছি অন্তত নিজের বাড়িটা বিক্রি করো না! তোর বাবা বলেছিলেন আমার ছেলের চাকরি হলে এরকম কত বাড়ি হবে, কত জমি-জমা হবে! আমার ছেলে যদি সুখী না হলো যার জন্য আমার সারাজীবন বিসর্জন দিলাম তার সুখের জন্য আমি কি বাড়ি টা বিক্রি করতে পারি না!
এগুলো সব বিক্রি করে তোরে ঘুষের টাকা দেয়। দিয়েই তো তুই চাকরি নিলি নাকি? ছেলে এখন সরকারি কর্মকর্তা, বিরাট বাড়ি ঘর অথচ সেখানের কোনো রুমে বাবার থাকার মতো জায়গা নাই তাই বৃদ্ধাশ্রমে!
…আসলে চাচা..(বলার কোনো ভাষা নাই!)
….চুপ সুহেল আর বলতে হবে না বৃষ্টি কমে গেছে চলো রিক্সা নিয়ে স্টেশনে যাই।
এই রিক্সা যাবে বাস স্টেশনে.. ( চাচা)
…হো মামা যামু!
…তাহলে সুহেল চলো আমার সাথে রাস্তায় নেমে যেও।
….জি চলেন, বাবার জন্য ঔষধ নিতে হবে!
… বাবা? তোমার বাবা না বৃদ্বাশ্রমে..
….জি ইয়ে মানে আমার শ্বশুর আব্বা!
….উনি এখানে থাকেন নাকি?
….জি! আমার ছেলের সাথে খেলাধুলা করেন। অথচ উনার মেয়ে ছাড়া তো কেউ নেই তাই এখানেই থাকেন।
….ওহ! তোমার বাবাও কিন্তু তোমার ছেলের সাথে খেলাধুলা করলে মন্দ হতো না। তোমার বাবারও তো তুমি ছাড়া কেউ নেই,আর বন্ধু বলেছিলে না কথা বলার মতো তাহলে তো তোমার শ্বশুরই ছিলেন।
(সুহেল চুপ কি করবে বুঝতে পারছে না)
…এই রিক্সা স্টেশনে কত দিতে হবে( চাচা)
….মামা ২০ টাকা। তবে একখান কথা মামা আমারে ১০ টাকা একটু বেশি দিতেন যদি আমার মেলা উপকার হইত! দেখেন না ২ ঘন্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে বৃষ্টির জন্য যাত্রী পাইনি এখন ঔষধ কিনতে আর ৫০ টাকার দরকার। সারাদিনে আজ ৩০০ টাকা ও হয় নাই! রিক্সার ভাড়া ১০০ দিয়ে বাবা-র জন্য ১০০ টাকার ঔষধ কিনব বাকি টাকা বউ- বাচ্চার লাগি তেল- ডাল কিনব কাল চাল কিনে নিয়ে গেছি!
…তোমার বাবা আছেন?
…হো মামা আব্বা আছেন, আব্বারে যদি শেষ সময় নিজের কামাই না খাওয়াই আল্লাহ তো নারাজ হইবেন। আব্বায় কত কষ্ট করে আমাদের বড় করছেন এখন আব্বারে কি ফেলে দিব! আজকে যদি আব্বার দেখাশোনা না করি তাইলে তো আমার ছেলেও আমি বুড়া হইলে আমারে দেখত না!
…..তার জন্য বুঝি সারা শরীর ভিজে কামাই করছো? ঠান্ডা লাগছে না তোমার, জ্বর আসবে তো!
….কত বৃষ্টিতে ভিজে অভ্যাস আছে, আমাদের কিছু হইব না। আপনি পলিথিনটা নিয়ে আপনার পায়ের কাছে রাখেন, না হলে বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাবেন। আর ভাই সাহেব আপনিও কি যাবেন উনার সাথে গেলে চলেন তাড়াতাড়ি আমার আরও যাত্রীরে নিয়ে যাইত হইব তা না হলে বাবার ঔষধ টা কিনতে পারমু না!
…..কি হলো সুহেল? চলো….
….চাচা আপনি যান আমি বাবাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাড়িতে নিয়ে যাব..
….সত্যি!(চোখে পানি চলে আসছে)
…হুম চাচা সত্যি ভালো থাকবেন আরেকবার ঢাকা আসলে আমাদের বাড়িতে বাবা কে দেখে যাবেন।(সুহেল)
…. অবশ্যই বাবা আসব আমি। ভালো থেকো,আল্লাহ যেন তোমার মঙ্গল করেন।
রিক্সাওয়ালাকে ৫০০ টাকা দিয়ে বললাম আজকের তোমার বাবার ঔষধের টাকা আর ১০০ নাও চাচাকে স্টেশনে দিয়ে এসো.. বাবার খেয়াল রেখো ভাই।তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার চোখ খুলে দেওয়ার জন্য।
আমি বাবাকে নিয়ে অটোতে বসে আছি বাবার চোখে-মুখে পৃথিবী জয়ের হাসি। অথচ নিয়ে আসার সময় দেখেছিলাম মলিন মুখ চাপা হাসির পিছনে লুকিয়ে ছিল দেখতে পারি নি! আজ মনে এতো শান্তি লাগছে! সত্যি লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়েছি ঠিকই কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হতে পারিনি! আমার মতো হয়তো কত সন্তান তাদের বাবাকেও এভাবে দূরে রেখেছে!
অথচ সবাই যদি আমার মতো নিজেকে সংশোধন করে নিয়ে বাবা-মাকে ফিরে নিয়ে আসত নিজের বাড়িতে, তাহলে হয়তো বৃদ্ধাশ্রম নামটা সমাজ থেকে মুছে যেতো।
লেখিকা: গল্পকার ও শিক্ষার্থী