উপমহাদেশের কিংবদন্তি আলেম শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এক জীবনে প্রবাদতুল্য অনেক কাজ করেছেন। তবে তার রেখে যাওয়া সবচেয়ে সুন্দর ফুলবাগানটির নাম জামিয়া রাহমানিয়া। এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্যের প্রতিটি কোণায় জড়িয়ে আছেন তিনি। শাইখুল হাদীস বলতে ব্যাকুল এক ঝাঁক দক্ষ আলেম সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রতিষ্ঠানটি। এই জামিয়া জন্ম দিয়েছে অসংখ্য যোগ্য আলেম, দক্ষ দাঈ, দীন ও ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আলেম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তালিম-তাদরিস, দাওয়াত-তাবলিগ, বয়ান-বক্তৃতা, সকল ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রাখছে রাহমানিয়ার কৃতী সন্তানরা।
শাইখুল হাদীস রহ. এর সব অনুরাগ ও ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাহমানিয়া। রাহমানিয়া বলতে তিনি পাগল ছিলেন। শেষ জীবনে যখন শায়েখের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। তখন অনেক কিছুই মনে করতে পারতেন না। সবকিছু ভুলে যাওয়ার সেই সময়েও রাহমানিয়ার স্মৃতি তার হৃদয়ে গাঁথা ছিল। যখন মাদরাসায় যাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়, তখনো প্রায়ই বলতেন ‘আমাকে মাদরাসায় নিয়ে যা। আমি মাদরাসায় যাব।’
একদিন তিনি একাই কাউকে না বলে আজিমপুরের বাসা থেকে বের হয়ে যান। তখন শায়েখের অবস্থা এমন ছিল যে, তিনি রিকশাচালককে গুছিয়ে বলতেও পারতেন না, কোথায় যাবেন। শুধু বলেছিলেন মাদরাসায় যাবেন। রিকশাচালক তাকে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করতে থাকে। এরপর পরিচিত একজন দেখে শায়েখকে বাসায় দিয়ে যান। শায়েখের সর্বশেষ যেবার ওমরার সফরে গেলেন, সেবার নানাজীর সঙ্গে মা-খালারা অনেকেই ছিলেন। আম্মার কাছ থেকে শুনেছি, মদিনায় আমাদের যে খালাম্মা থাকতেন, সেই খালার বাসায় থেকে প্রায়ই বের হয়ে যেতে চাইতেন, বলতেন ‘আমাকে রাহমানিয়ায় নিয়ে যা। আমি মাদরাসায় যাব। রাহমানিয়ার জন্য তিনি এতটাই ব্যাকুল ছিলেন।
কত স্মৃতি! প্রায় দেড় বছর রাহমানিয়ার বাইরে থাকার পর শাইখুল হাদীস রহ. যখন আবার রাহমানিয়ায় ফিরে এলেন সেই সময়ের কথা মনে পড়ে। শায়েখ আবার রাহমানিয়ায় ফিরে আসায় ছাত্রদের মধ্যে কি পরিমাণ আনন্দ বিরাজ করছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। রাহমানিয়ার ইতিহাসে ঐ বছরই ভর্তির সময় সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছিল। আমার মনে পড়ে, ভর্তির দিন সকাল সকাল মাদরাসায় এলাম। এসে দেখি অফিসের সামনে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল সবাই। অফিস, করিডোর আর সিরিতে এমন ভীড় হয়েছিল যে, এক পর্যায়ে ছাত্রদের চাপে অফিস কক্ষের দেয়ালে টাঙানো কাচটি বিকট শব্দে ভেঙে গেল। সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। রাহমানিয়ায় এতকাল ধরে আছি, এমন ভিড় কখনো দেখিনি।
রাহমানিয়া ভবনে নতুনভাবে শুরু হলো আমাদের পড়াশুনা। রাহমানিয়ার ছাত্রদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল, শাইখুল হাদীসের বরকতময় উপস্থিতি। তিনি তখন মাদরাসায়ই বেশি থাকতেন। অনেকটা সুস্থ ছিলেন। বার্ধক্য তখনো তাকে গ্রাস করতে পারেনি। নিয়মিত চার পাঁচটি মাদরাসায় বুখারি শরিফের দরস দিতেন। ফজরের পর রাহমানিয়ায়। এরপর যেতেন মিরপুর জামিউল উলুম, মিরপুর দারুস সালাম ও লালমাটিয়া মাদরাসাসহ আরও কয়েকটি মাদরাসায়।
দরস প্রদান শেষ করে দুপুরে রাহমানিয়ায় এসে একটু বিশ্রাম নিতেন। এরপর বিকেলে আবার রওনা হতেন মাহফিলের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। রাজনৈতিক প্রোগ্রাম থাকলে শরিক হতেন। সন্ধ্যার পর বা এশার পর মাঝে মাঝে রুমে গিয়ে দেখা করতাম। আমাকে দেখলেই প্রথমেই প্রশ্ন করতেন, ‘কীরে, তোর মা কেমন আছে? সব সময়ই এটা জিজ্ঞেস করতেন। এরপর, তোর আব্বা কেমন আছে? এরপর পরীক্ষায় কত হইছোছ?’ এগুলো ছিল নিয়মিত প্রশ্ন। আমি উত্তর দিতাম। কথা প্রসঙ্গে আরও অনেক গল্প করতাম।
এমন সব মধুর স্মৃতি এবং শাইখুল হাদীস রহ. এর বুখারির দরসে বসার অপেক্ষায় কেটেছে লম্বা একটা সময়। নিয়মিত সবক ইফতিতাহ আর বিভিন্ন কিতাবের শেষ সবক শায়েখের কাছে পড়া হলেও বুখারির দরস গ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণ আসে দাওরায়ে হাদীসের বছর। শাইখুল হাদীস রহ. এর মতো কিংবদন্তির কাছে বুখারি পড়ার সুযোগ হয়েছে, এজন্য নিজেকে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে হয়। আমাদের বছর শায়েখের স্মৃতিশক্তি এতটুকু ছিল যে, তিনি দরসে বসে প্রয়োজনে বুখারি শরিফের হাশিয়া পড়েছেন, ছাত্র কম দেখলে হাজিরা ডেকেছেন। আমি কখনো দরসে পেছনে বসলে জিজ্ঞেস করেছেন, কিরে তুই পিছনে কেন………